কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে ধান কাটার মৌসুম শুরুর আগেই জমে উঠেছে এক ব্যতিক্রমী উৎসব। কৃষকরা এখানে শ্রমিক না হয়েও অন্যের ধান কেটে দিচ্ছেন, আর তার বিনিময়ে পাচ্ছেন প্রয়োজনীয় খড়। গরুর খাদ্য সংকট মেটানোর এই প্রথা এখন স্থানীয়ভাবে রীতিমতো উৎসবে রূপ নিয়েছে।
পানান বিল ঘেঁষা মধ্য লাখুহাটি গ্রামের কৃষক হারিছ মিয়া তার একশ শতাংশ জমিতে লাগানো ধান তুলনামূলক আগেভাগে ঘরে তোলার মতো হয়ে গেলে ধান কাটার ঘোষণা দেন। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই আশপাশের এলাকার প্রায় ৩০-৪০ জন কৃষক দলবেঁধে তার জমিতে ধান কাটতে আসেন। কিন্তু তারা কোনো মজুরি নেননি। বরং বিনিময়ে পেয়েছেন কাটার পর জমিতে পড়ে থাকা খড়, যা গরুর খাদ্য হিসেবে অমূল্য সম্পদ।
কৃষক হারিছ মিয়ার মুখে হাসি
হারিছ মিয়া জানান, "আমি যে পরিমাণ জমির ধান কেটেছি, তা কাটাতে শ্রমিক খরচ পড়ত প্রায় ১০ হাজার টাকা। কিন্তু খড়ের বিনিময়ে ধান কেটে দেয়ায় সেই খরচ একেবারেই লাগেনি।"
তিনি আরও বলেন, “একটু খড় কম পেলেও সমস্যা নেই। কয়েকদিন পর যখন অন্যদের জমি পাঁকবে, তখন সেখান থেকেও খড় পাওয়া যাবে।”
খড়ের টানে জমিতে কৃষকদের ভিড়
আশপাশের কৃষকেরা জানালেন, খড়ের সংকট এড়াতে তারা প্রতি বছরই যাদের জমির ধান আগে পাকে, তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনটি গরুর মালিক কৃষক আফছর মিয়া বলেন, “আমার খড় শেষ হয়ে গেছে। নিজের জমির ধান পাকতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। তাই খড়ের জন্য এসেছি হারিছ ভাইয়ের জমিতে ধান কাটতে।”
এই ধান কাটার রীতি নতুন নয়। বছর কয়েক ধরে হোসেনপুরের বিভিন্ন বিলে এমন ধান কাটা উৎসব হচ্ছে। ধান আগে পাকলে ধান কাটা ফেলে রাখা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে, অনেক কৃষক গরুর খাবার খড়ের জন্য বিপাকে পড়েন। এই দুই পক্ষের চাহিদা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে 'খড়ের বিনিময়ে ধান কাটা'র প্রথা। এখন এটি সামাজিক ঐক্য এবং সহযোগিতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
প্রাকৃতিক সহায়তায় বাম্পার ফলনের আশা
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাদিকুর রহমান বলেন, “আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষকেরা ইতোমধ্যে ধান কাটা শুরু করেছেন। অনেক জায়গায় খড়ের উৎসবও দেখা যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, এবার বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হবে।”
তিনি আরও জানান, আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে পুরো জেলায় ধান কাটার কাজ পুরোদমে শুরু হবে। এ বছর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে কৃষকের মুখে থাকবে হাসি।
খড়ের মাধ্যমে তৈরি হলো সহমর্মিতার সেতুবন্ধন
এই ধান কাটা উৎসব কেবল একটি চাষাবাদের কাজ নয়, এটি হয়ে উঠেছে গ্রামীণ সমাজের পারস্পরিক সহায়তার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। একদিকে খরচ বাঁচিয়ে কৃষকের লাভ হচ্ছে, অন্যদিকে গরুর খাবারের সংকট মিটছে বিনিময় পদ্ধতির মাধ্যমে। এই উৎসব শুধু ফসল ঘরে তোলার নয়, বরং সেটা হয়ে উঠেছে মানুষের সাথে মানুষের বন্ধনের এক অসাধারণ রূপ।
এই ধারা যদি অন্যান্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে কৃষি খাতে খরচ কমানোর পাশাপাশি সামাজিক সহযোগিতার মনোভাবও আরও দৃঢ় হবে বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
Post a Comment