কিশোরগঞ্জ হাওরে ধান কাটার ব্যস্ততা, কিন্তু দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা

কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরজুড়ে এখন সোনালি ধানের সমারোহ। কাঁচা-পাকা ধানের শিষ বাতাসে দুলছে, চোখ জুড়ানো এই দৃশ্য দেখে যেন প্রকৃতি নিজেই জানান দিচ্ছে ফসল ঘরে তোলার সময় এসেছে। হাওরের কৃষক-কৃষাণীরা তাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছেন ফসল কেটে ঘরে তুলতে। তবে ধানের দাম নিয়ে রয়েছে প্রচণ্ড উদ্বেগ।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে কিশোরগঞ্জে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর। এর মধ্যে শুধু হাওর অঞ্চলে আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে। এই বিপুল আবাদ থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯১২ মেট্রিক টন চাল, যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।

সরকার চলতি বছর ধানের সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজি ৩৯ টাকা এবং চালের মূল্য ৪৮ টাকা কেজি। যদিও গত বছর প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে ১২০০ টাকায়, এবার তা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪৪০ টাকা। তবুও বাজারে কৃষকরা ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন ৮২০ থেকে ৯০০ টাকা মণ দরে, যা উৎপাদন খরচের কাছাকাছি। এতে তারা আশানুরূপ লাভ করতে পারছেন না।

হাওরের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক জানান, “আমার দুই একর জমিতে বোরো ২৮ জাতের ধান হয়েছে। ফলন ভালো হলেও শ্রমিক সংকটে পড়েছি। পরিবার এবং স্থানীয় শ্রমিকদের সাহায্য নিয়ে ধান কাটছি। ন্যায্যমূল্য পেলে লাভবান হবো, নয়তো ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি মিলবে না।”

আরেক কৃষক মাসুদ মিয়ার ভাষ্যে, “ঋণ করে ধান চাষ করেছি। ফলন ভালো, এখন বাজার দর ভালো না হলে আমাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে।”

হাওরের কৃষক আব্দুল মান্নান বলেন, “আমরা হাইব্রিড ছক্কা, ফাইজং ও হাইব্রিড ২৯ জাতের ধান করেছি। ফলন সন্তোষজনক। শুনেছি হাওরে ভালোভাবে বাঁধ হয়েছে, তাই বন্যার শঙ্কা কম। এই ফসল যদি কোনোভাবে ক্ষতি না হয়, সেটাই বড় প্রার্থনা।”

চলতি মৌসুমে আগাম পাহাড়ি ঢল ও বন্যা প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে ১২৯টি ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছে। যার মোট দৈর্ঘ্য ১৫০ কিলোমিটার এবং ব্যয় হয়েছে ২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

এদিকে ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক সংকট কিছুটা কাটাতে বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক দল আসছে। নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর থেকে আসা ১৬ সদস্যের একটি দল জানায়, এবার শ্রমিকদের পারিশ্রমিক কিছুটা কম, কারণ অনেক জায়গায় হার্ভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে।

হার্ভেস্টার মালিক মাহবুবুর রহমান বলেন, “মেশিন দিয়ে ১ একর জমির ধান মাত্র ১ ঘণ্টায় কাটা যায়। এতে কৃষকদের সময় ও খরচ দুই-ই সাশ্রয় হচ্ছে।”

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. সাদিকুর রহমান বলেন, “চলতি বছর কিশোরগঞ্জে আবাদ এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। হাওরের ফলনও ভালো হয়েছে। সরকার নির্বাচিত কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান-চাল সংগ্রহ করবে নির্ধারিত দরে।”

হাওরের ফসল ঘরে তুলতে শুরু হলেও বাজারে ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষকদের মুখে হাসি ফিরবে না। তাই সময়মতো সরকারি সংগ্রহ কার্যক্রম শুরুর পাশাপাশি কৃষকদের পাশে থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন সচেতন মহল।

Post a Comment

Previous Post Next Post