নববর্ষে কিশোরগঞ্জে বাউল সংগীতের জাদু, সমাজ উন্নয়নে ভিন্নধর্মী উদ্যোগ "জীবিকা"-এর

বাংলা নববর্ষের দ্বিতীয় দিন, ২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ। কিশোরগঞ্জ পৌরসভার গেটসংলগ্ন পৌরপার্ক চত্বর যেন এক অন্যরকম আবহে জেগে উঠেছে। সন্ধ্যার শীতল বাতাসে ভেসে আসছে একের পর এক বাউল গানের সুর। ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মেলবন্ধনে ‘বাউল সন্ধ্যা’ নামে এই আয়োজন করেছে ‘জীবিকা মানব উন্নয়ন সংস্থা’ নামের একটি স্থানীয় সংগঠন।

‘জীবন বিকাশে কাজ করি, স্বনির্ভর কিশোরগঞ্জ গড়ি’—এই প্রেরণামূলক স্লোগানকে সামনে রেখে তারা আয়োজন করেছে এই ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার। মূলত সমাজে সুস্থ বিনোদনের পরিবেশ তৈরিতে এবং মানুষের মাঝে বাউল সংগীতের গুরুত্ব তুলে ধরতেই এ আয়োজন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।

সংগঠনের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য জানান, “আমরা লক্ষ্য করেছি, কিশোরগঞ্জে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক সম্পদ ও প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সমাজে ইতিবাচক বিনোদনের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। কোনো ব্যক্তি কিংবা সংগঠন নিয়মিতভাবে এমন আয়োজন করে না। তাই আমরা ভাবলাম, সমাজে বিনোদনের একটি স্বতন্ত্র ও গঠনমূলক পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব আমাদেরও আছে। সেই ভাবনা থেকেই বাউল সন্ধ্যার আয়োজন।”

তিনি আরও বলেন, “বাউল গান শুধু বিনোদন নয়, এটি এক ধরনের দর্শন। যেখানে আত্মার মুক্তি, মানবতার বাণী ও সমাজের নানা অসঙ্গতির প্রতিবাদ উঠে আসে সহজ ও সরল ভাষায়। নতুন প্রজন্ম যেন এসব গানের গভীরতা বুঝে, সে উদ্দেশ্যও আমাদের এই আয়োজনে রয়েছে।”

সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় সংগীতানুষ্ঠান। স্থানীয় বাউল শিল্পীরা তাদের নিজস্ব ঢঙে পরিবেশন করেন লালন সাঁই, হাছন রাজা, রাধারমন দত্তসহ বিভিন্ন প্রখ্যাত বাউল কবির গান। গানের সঙ্গে তানপুরা, দোতারা ও একতারা-সহ নানা দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো পার্ক এলাকা। দর্শকদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন বয়সের মানুষ, যাদের চোখেমুখে আনন্দ ও মুগ্ধতা স্পষ্ট।

এই আয়োজন নিয়ে কিশোরগঞ্জের এক সাংস্কৃতিককর্মী বলেন, “বর্তমানে আমাদের তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছে, যার কারণে তারা নিজেদের শিকড় ভুলে যাচ্ছে। এমন আয়োজনে তারা বাংলা সংস্কৃতির প্রতি আবার আগ্রহী হয়ে উঠবে বলে আমি মনে করি।”

বাউল সন্ধ্যার মাধ্যমে ‘জীবিকা মানব উন্নয়ন সংস্থা’ কেবল একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই আয়োজন করেনি, বরং তারা সমাজে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে—সুস্থ সংস্কৃতি এবং সংগীতচর্চার মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব।

অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকরা জানান, ভবিষ্যতেও তারা এ ধরনের আয়োজন নিয়মিত করতে চায়। বিশেষ করে তরুণদের জন্য সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ, লোকগানের কর্মশালা এবং স্থানীয় প্রতিভা আবিষ্কারের উদ্যোগ তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে।

কিশোরগঞ্জের সাধারণ মানুষের কাছে এ আয়োজন যেন হয়ে উঠেছে এক ধরনের প্রেরণা—যেখানে গান আছে, গানে আছে সমাজ বদলের বার্তা।

Post a Comment

Previous Post Next Post