ভুট্টা চাষে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল, কৃষকের মুখে হাসি

আদিবা আক্তার। কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি | ৮ এপ্রিল ২০২৫

কিশোরগঞ্জের হাওরপাড়ে কৃষক জীবনযাত্রায় আসছে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন। গত কয়েক বছরে ধাননির্ভর কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে এখন ভুট্টা চাষে ঝুঁকেছেন হাওরাঞ্চলের অনেক কৃষক। কম খরচে বেশি লাভ, আগাম ফসল ঘরে তোলার সুবিধা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কম থাকায় ভুট্টা এখন এ অঞ্চলের অন্যতম আস্থার ফসলে পরিণত হয়েছে।

হাওরের উঁচু জমিগুলোতে আগে যেখানে ফসল ফলানো হতো না, এখন সেখানে সোনালী রঙের ভুট্টা যেন রোদের আলোয় সোনালী স্বপ্নের প্রতীক হয়ে উঠেছে। জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে কিশোরগঞ্জ জেলায় ভুট্টা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২,১০০ হেক্টর জমি, যা ছাড়িয়ে গিয়ে ১২,২১০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও ছাপিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

চার উপজেলায় ব্যাপক ভুট্টা চাষ, নিকলী শীর্ষে

জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুট্টা চাষ হয়েছে হাওরঘেরা চারটি উপজেলায়—নিকলী, মিঠামইন, বাজিতপুর ও অষ্টগ্রাম। এর মধ্যে শুধু নিকলী উপজেলাতেই ভুট্টা আবাদ হয়েছে ৩,১১০ হেক্টর জমিতে। মিঠামইনে ২,৮৮০ হেক্টর, বাজিতপুরে ২,০১০ হেক্টর এবং অষ্টগ্রামে ৯৮০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। সর্বত্রই ফলন হয়েছে বাম্পার, ফলে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে ফিরে এসেছে নতুন আশার আলো।

ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন সম্ভাবনা

হাওর এলাকার কৃষক আব্দুর রহিম বলেন, "আগে ধান চাষ করতাম, কিন্তু বন্যা হলে ক্ষতি হতো। এখন ভুট্টা চাষ করি—ফসল ঘরে তোলা যায় আগেই, আর লাভও হয় ভালো।"

শরিফ উদ্দিন নামের আরেক কৃষক জানান, তার জমিগুলো আগে পতিত থাকলেও এখন সেখানে ভুট্টা চাষ করছেন। তার ভাষায়, “ফলন ভালো হয়েছে, যদি দরদাম ঠিক থাকে, তাহলে এবার ভালো লাভ হবে। কৃষি অফিস থেকেও ভালো সহায়তা পেয়েছি।”

ইটনা উপজেলার কৃষক নাজিম উদ্দিন বলেন, “ভুট্টা চাষে তিনভাবে লাভ হয়—শুকনা ভুট্টা বিক্রি, কাঁচা পাতাগুলো গরুকে খাওয়ানো, আর গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা। এমন বহুমুখী ব্যবহার সত্যিই আশীর্বাদস্বরূপ।”

প্রশাসনের সার্বিক সহায়তা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. সাদিকুর রহমান জানান, “হাওরে আগাম বন্যার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু ভুট্টা এমন একটি ফসল, যা বর্ষার আগেই ঘরে তোলা যায়। কৃষকদের চাহিদা ও লাভ বিবেচনায় ভুট্টা চাষে আগ্রহ বাড়ছে। কৃষি বিভাগ মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত প্রযুক্তি সহায়তা, সঠিক বীজ নির্বাচন, সার প্রয়োগ এবং রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে কৃষকদের সহায়তা করে যাচ্ছে।”

দাম ভালো, বিক্রি হচ্ছে মাঠ থেকেই

চলতি মৌসুমে মাঠ পর্যায়ে মণপ্রতি ভুট্টার দাম ধরা হচ্ছে ১,০০০ থেকে ১,১০০ টাকা পর্যন্ত, যা গত বছরের তুলনায় বেশি। এই দাম কৃষকদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে। অনেক পাইকার মাঠেই এসে ভুট্টা কিনে নিচ্ছেন, ফলে কৃষকদের পরিবহন ব্যয়ও বেঁচে যাচ্ছে।

ভবিষ্যতের পথে হাওরের কৃষি

বাংলাদেশে পোল্ট্রি ও ফিড ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপক চাহিদার কারণে ভুট্টার বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধাননির্ভর কৃষি থেকে ধীরে ধীরে বহুমুখী চাষে রূপ নিচ্ছে। কৃষি অর্থনীতিতে এই রূপান্তর শুধু আয়ের পথই খুলে দিচ্ছে না, বরং একটি টেকসই কৃষিনির্ভর সমাজ বিনির্মাণেও ভূমিকা রাখছে।

ভুট্টা চাষ এখন আর শুধুই একটি ফসল উৎপাদনের বিষয় নয়, এটি হয়ে উঠেছে হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার নতুন চালিকাশক্তি। হাওরে যেন ধানের জায়গা দখল করে নিচ্ছে একরাশ সোনালী ভুট্টা—যা বদলে দিচ্ছে কিশোরগঞ্জের কৃষিচিত্র।

Post a Comment

Previous Post Next Post