স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও বাস্তব চিত্র যেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালের বর্তমান অবস্থা দেখলে মনে হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি আধুনিক হলেও সরকারি হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো ও সেবার মান যেন আরও অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে। সরজমিনে পরিদর্শনে উঠে এসেছে একের পর এক অপ্রিয় বাস্তবতা, যা সাধারণ রোগীদের জন্য পরিণত হয়েছে নিত্যদিনের দুর্ভোগে।
প্রথমেই বলা যেতে পারে টিকিট সংগ্রহের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা। হাসপাতালে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই রোগীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় শুধুমাত্র একটি টিকিট কাটার জন্য। অনেক সময় এই লাইনে দাঁড়িয়েই রোগীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে অক্ষম রোগীদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। টিকিট রুমটি অত্যন্ত ছোট এবং অপর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের কারণে সেখানে সৃষ্টি হয় দমবন্ধ পরিবেশ। একই কক্ষে ওষুধের জন্য আলাদা লাইন থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
টিকিট সংগ্রহের পর শুরু হয় আরেক অধ্যায়—ডাক্তারের দেখা পাওয়া। একজন রোগী বলেন, "অনেক কষ্ট করে আসি, কিন্তু ডাক্তার ভালোভাবে কথা শোনেন না। কিছু না দেখে ওষুধ লিখে দেন।" আরেকজন জানান, "ডাক্তার আমাদের নির্দিষ্ট ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে বলেন।" এমনকি হাসপাতালের ভেতরেই কিছু ব্যক্তি রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে নেন, যা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় ওষুধ কোম্পানির প্রভাব সম্পর্কে।
হাসপাতালের ভেতরের অবকাঠামোগত দুর্বলতা রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। হাসপাতালের চারতলা ভবনের লিফটের সামনের ফ্লোরে একটি বড় গর্ত রয়েছে, যেখানে যেকোনো শিশু বা অসতর্ক রোগী সহজেই পা আটকে পড়ে গুরুতর আহত হতে পারে। সাততলা ভবনের লিফটের অবস্থাও ভয়াবহ। লিফটের দরজার সেন্সর ঠিকমতো কাজ করে না এবং সেখানে কোনো ডিসপ্লে নেই। প্রতিদিন শতশত রোগী স্ট্রেচারে করে উপরে নিচে নেওয়া হয় এই লিফটে, যা বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে।
পরিচ্ছন্নতার অভাবও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। হাসপাতালের টয়লেটগুলো দুর্গন্ধযুক্ত এবং নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সেগুলো ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা আবর্জনা ও নোংরা পরিবেশ রোগীদের সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলছে।
এই চিত্র শুধু কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালের নয়; জেলার অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থাও প্রায় একইরকম। প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষ যখন চিকিৎসা নিতে এসে দুর্ব্যবস্থা, অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে—এই স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার জন্য?
সচেতন মহল মনে করছেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রোগীরা বলছেন, চিকিৎসা সেবাকে জনবান্ধব করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বচ্ছতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে হবে।
Post a Comment